বুধবার, ১৭ অগাস্ট ২০২২, ০২:০৮ পূর্বাহ্ন
আবদুল আজিজ:
ধ্বংসের পথে কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত জেলার একমাত্র ইউনিভার্সিটি নিয়ে উদ্বিগ্ন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা পদ নিয়ে টানাটানি, অনিয়ম-দুর্নীতি ও করোনায় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধসহ নানা কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে দু’পক্ষের চলমান মামলায় আইনি জটিলতায় বিশ্ববিদ্যালয়টির পাঠ কার্যক্রম অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। একারণে স্টুডেন্ট ফোরামের ব্যানারে ২০ দফা দাবিতে আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের অংশ হিসাবে মঙ্গলবার দুপুরে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে একটি মানববন্ধনও করেছে এই ছাত্র ফোরাম।
মানববন্ধনে স্টুডেন্ট ফোরামের সমন্বয়ক আবিদ সাইদ ও হোসাইন মুরাদ প্রিন্স হুশায়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘ বর্তমানে ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের অনিয়ম অব্যবস্থাপনা ও লুটপাটের কারণে এর শিক্ষা কার্যক্রম নিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে। বিগত কোভিড কালীন দেড় বছরে কোন ধরনের অনলাইন ক্লাস নেয়নি। কিন্তু কোর্স ফি নিয়ে শিক্ষার্থীদের টাকা আত্মসাত করছে কর্তৃপক্ষ। ইউনিভার্সিটিতে এখনো ভিসি নিয়োগ দেয়া হয়নি। নিয়মিত কোন ট্রেজারার নেই। বিগত আট বছরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্হায়ী ক্যাম্পাস গড়ে তুলেনি। পরে ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হয়।
২০১৩ সালে কক্সবাজার শহরের কলাতলী মোড়ে একটি অস্থায়ী ক্যাম্পাসে গড়ে উঠে কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। লায়ন মুজিবুর রহমানকে প্রতিষ্ঠাতা ও সালাহ উদ্দিন আহমেদকে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান করে ১০ সদস্য বিশিষ্ট ট্রাস্ট বোর্ড নিয়ে প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে ভালই চলছিল উক্ত ইউনিভার্সিটির কার্যক্রম। কিন্তু, গত এক বছর আগে প্রতিষ্ঠাতা পদ নিয়ে শুরু হয় রশি টানাটানি। ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠাতা লায়ন মুজিবুর রহমানকে বাদ দিয়ে ট্রাস্টি বোর্ড চেয়ারম্যান সালাহ উদ্দিন আহমদ নিজেকে প্রতিষ্ঠাতা দাবি করেন। আবার লায়ন মুজিবুর রহমান সালাহ উদ্দিন আহমদকে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মেনে নিলেও প্রতিষ্ঠাতা মানতে রাজি নয়। ইউনিভার্সিটিতে এক বছর আগে থেকে দখলে নেয় সালাহ উদ্দিন আহমদ। এনিয়ে একে অপরের সাথে মামলায় জড়িয়ে পড়ে। এসব মামলা জটিলতায় ঝিমিয়ে পড়ে ইউনিভার্সিটির সকল কার্যক্রম। ১২০০ শিক্ষার্থী নিয়ে পুরোদমে চালু হওয়া ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭০০ জনে নেমে আসে। এতে শংকিত হয়ে পড়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ অবস্থায় স্টুডেন্ট ফোরামের ব্যানারে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ২০ দফা দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচীর ডাক দেয়।
উক্ত কর্মসূচীতে স্টুডেন্ট ফোরামের দাবি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগকৃত উপচার্য ও কোষাধ্যক্ষ, স্থায়ী ক্যাম্পাস, উন্নত ক্লাসরুম, যোগ্যতা সম্পন্ন রেজিষ্ট্রার, প্রক্টর ও ডিন, পর্যাপ্ত মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ, স্বয়ং সম্পূর্ণ লাইব্রেরী ও কার্যকর ওয়েবসাইট, হিসাবরক্ষণ বিভাগকে পূর্ণবিন্যাস, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সেমিষ্টার সম্পন্ন করা, জরিমানা ও সেমিষ্টার ফি’র জন্য নির্দিষ্ট নিয়মকানুন করা, ট্রাস্টি বোর্ড ও প্রশাসনের গোলযোগ থেকে শিক্ষা কার্যক্রমকে মুক্ত রাখা, নিরপেক্ষ পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নিশ্চিতকরণ, সুগঠিত একাডেমিক ক্যালেন্ডার, কমন রুম ল্যাব সুবিধা নিশ্চিতকরণ, জাতীয় দিবস, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিক্ষা সফর ও ইন্ড্রাস্টিয়াল ভিসিট এবং কর্মশালার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে অর্থায়ন নিশ্চিতকরণ, প্রতিষ্ঠিত এবং সক্রিয় ক্লাব সমূহকে প্রণোদনা ও অর্থায়ন নিশ্চিতকরণ, ক্যান্টিন সুবিধা নিশ্চিতকরণ, মানসম্মত শৌচাগার নিশ্চিতকরণ, বহিরাগতদের অবাধ বিচরণ বন্ধ এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং ট্রাস্টি বোর্ডের দ্বন্দের নিরসন।
এবিষয়ে স্টুডেন্ট ফোরামের মুখপাত্র আরিফ সাঈদ বলেন, প্রতি সেমিষ্টার ( ৬ মাস) থেকে প্রায়ই আড়াই কোটি টাকা আয় করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অথচ আমাদের নেই মানসম্মত শৌচাগারও। শুধু নামের একটি ইউনিভার্সিটি রয়েছে আমাদের। বিষয়গুলো নিয়ে আমরা অনেকবার কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেছি। বারবার তারা আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু, কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
জানতে চাইলে ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা লায়ন মুজিবুর রহমান বলেন, ‘উচ্চ শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া কক্সবাজার জেলাকে এগিয়ে নিতে ২০১৩ সালে কক্সবাজার কলাতলী মোড়ে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠাতা করা হয়। এতে ১০ সদস্য বিশিষ্ট ট্র্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়। পরে ট্রাস্ট গঠন সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক সালাহ উদ্দীন আহমদকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব অর্পণ করা হয় বিনা অর্থে। আমাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ২১/০৫/২০১৩ইং তারিখ শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইউজিসিকে মতামত প্রদানের জন্য চিঠি দেন এবং সেই অনুযায়ী গত ২৬/০৬/২০১৩ ইং তারিখ ইউজিসির তদন্ত টিম সরেজমিন পরিদর্শনে আসবেন। এসময়ও আবেদনপত্রে দেয়া তথ্য অনুযায়ী আমাকে প্রতিষ্ঠাতা, নিজেকে ট্রাস্টের চেয়ারম্যান এবং বাকী ৮জন সদস্যদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। তদন্ত টিমের পরামর্শ মোতাবেক ২৭/০৬/২০১৩ ইং তারিখ কক্সবাজার সদর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে আমাদের ট্রাস্ট দলিল রেজিস্ট্রেশন করি এবং তদন্ত টিমের কাছে তা জমা প্রদান করি। উক্ত ট্রাস্ট দলিল প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আমার স্বাক্ষরে সম্পাদিত হয় এবং গ্রহীতা হিসাবে সালাহ উদ্দীনসহ ১০জন সদস্যের সকলেই স্বাক্ষর করেন। পরে তদন্ত টিম তথ্য-উপাত্ত বিবেচনা করে, দালিলিক প্রমাণ সাপেক্ষে লায়ন মো: মুজিবুর রহমানকে প্রতিষ্ঠাতা করে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাময়িক অনুমোদনের জন্য ০৩/০৭/২০১৩ ইং তারিখ শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ/মতামত প্রদান করেন। সেই সুপারিশের ভিত্তিতে আমি লায়ন মো: মুজিবুর রহমানকে প্রতিষ্ঠাতা নির্ধারণ করে ১৫/০৯/২০১৩ ইং তারিখ শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ০৬/১০/২০১৩ ইং তারিখ ইউজিসি কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অনুমোদন প্রদান করেন।
মজিবুর রহমান বলেন, ‘ আমাদের নামের ছাড়পত্রের মেয়াদ থাকাবস্থায় সালাহ উদ্দীন তার কর্তৃক সৃজিত আরেকটি ভূয়া ট্রাস্ট দলিল এর মাধ্যমে নিবন্ধনের জন্য ছাড়পত্র নিয়ে সাবমিট করে দেয়। এভাবে সালাহ উদ্দীন তার কৃতকর্মের মাধ্যমে জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ এন্ড ফার্মসকে বিতর্কের দিকে ঠেলে দেয়। ইতিমধ্যে আমরা অনভিপ্রেত সম্পূর্ণ বিষয়টি বর্ণনা করে রেজিস্ট্রারের বরাবরে অভিযোগ দায়ের করেছি এবং কোর্টকেও অবগত করেছি। ১ম যুগ্ম জেলা জজ আদালত, চট্টগ্রাম ইতিমধ্যে সালাহ উদ্দীন কর্তৃক সৃজিত ভূয়া ট্রাস্ট কেন অবৈধ ঘোষণা হবে না সেই মর্মে জবাব চেয়েছেন এবং জবাব প্রদান না করা পর্যন্ত উক্ত ট্রাস্টের সকল কার্যক্রমের উপর স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন।’
এদিকে সালাহ উদ্দিন আহমদ নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠাতা দাবি করে বলেন-‘ আমিই কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা। আমি নিজে এই বিশ^বিদ্যালয়ের আবেদনকারী। যা ১২ মে ২০১৩ তারিখে আমার তরফে করা হয়। আবেদনে প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ৩০০ টাকার নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে সরকারের বরাবর অঙ্গীকারনামা প্রদানকারীও আমি সালাহউদ্দিন আহমদ। যা ২ মে ২০১৩ তারিখে প্রদান করা হয়। বোর্ড অব ট্রাস্টিজের আবেদনকারী হিসেবে আমি আবেদনে স্বাক্ষর করি এবং বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান হিসেবে বিশ^বিদ্যালয়ের প্রথম প্রস্তাবিত উপচার্য প্রফেসর শ্যামল কান্তি বিশ^াস, উপ উপাচার্য ও ট্রেজারারকে নিয়োগপত্র প্রদান করি আমি সালাহউদ্দিন আহমদ। তারা আমার বরাবরে স্ব স্ব পদে যোগদানের সম্মতিপত্র দাখিল করে। বিশ^বিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ভবনের ভাড়া নামা চুক্তি সম্পাদন করি আমি। কিন্তু আমি লক্ষ্য করি যে, বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় সাময়িক অনুমতি প্রাপ্তির আবেদন ফরমের ৩নং ক্রমিকে প্রতিষ্ঠাতার নাম ও ঠিকানার অংশটুকু পাল্টে দিয়ে সেখানে আমার স্থলে মো. মুজিবুর রহমানের নাম ও ঠিকানা জুড়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্যগণের নাম ও ঠিকানার জায়গায় স্বাধীনতার পক্ষ শক্তির ব্যক্তিবর্গের নাম বাদ দিয়ে সেখানে ১০ সদস্য বিশিষ্ট প্রস্তাবিত ট্রাস্টি বোর্ডের নয়জনই মো. মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের অন্তর্ভূক্ত করা হয়
মুজিবুর রহমান নিজেই একজন দুর্নীতিবাজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে মঞ্জুরী কমিশনের একটি চিঠির কথা উল্লেখ করে সালাহ উদ্দিন আহমদ জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ফাউন্ডার হিসাবে সে বিশ্ববিদ্যালয়টি শুরু থেকে পরিচালনা করত। কিন্তু, ১২০০ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে প্রতিবছর ৭ কোটি টাকা আয় করা হয়। প্রতিদিন ব্যাংকে জমাকৃত টাকা গুলো সন্ধ্যাবেলায় নামে বেনামে নগদ চেকের মাধ্যমে উত্তোলন করে মুজিবুর রহমান ও ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও হিসাব পরিচালনাকারি আব্দুর সরুর দুইজন মিলে ব্যাংক শুন্য করে বিশ্ববিদ্যালয়কে দেউলিয়া বানিয়ে রেখেছে। পরে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়।
ভয়েস/আআ