শুক্রবার, ০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৩, ০২:৪৭ পূর্বাহ্ন
গাজী তানজিয়া:
নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে স্কুলগুলোতে পরীক্ষা, আর জানুয়ারি মাসে থাকে নতুন বইয়ের চাহিদা, ঠিক তখনই কাগজের বাজারে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। কাগজের অতিরিক্ত দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে বিপাকে পড়েছেন এ দেশের সৃজনশীল বই প্রকাশকরাও। তারা আগামী বছর ফেব্রুয়ারি বইমেলায় নতুন বই নিয়ে আসতে পারবেন কি নাএ নিয়ে সংশয়ে আছেন।
সংবাদপত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাগজের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আগামীতে পত্রিকাশিল্পও ভয়াবহ সংকটের মধ্যে পড়ে যাবে। একই সঙ্গে বেকায়দায় পড়েছে তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন শিল্পে দরকারি কার্টন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এরই মধ্যে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে দাবি করে উদ্যোক্তারা বলছেন, ইচ্ছেমতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কাগজের মিলগুলো। এভাবে চলতে থাকলে দেশ-বিদেশে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থাপনায়ও বড় সংকটের আশঙ্কা রয়েছে।
অন্যদিকে পত্রিকার এক সংবাদে প্রকাশ, কাগজের অতিরিক্ত দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর অর্থের অভাবে বার্ষিক পরীক্ষার খাতা সরবরাহ করতে পারছে না। দেশের ৬৭ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হচ্ছে আজ (৬ ডিসেম্বর) থেকে। শিক্ষার্থীদের ফাইনাল পরীক্ষার বিষয়ে সম্প্রতি এক নির্দেশনায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) বলেছে, বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের বোর্ডে প্রশ্নপত্র লিখে মূল্যায়ন কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। কোনো শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অধিক হলে সে ক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র হাতে লিখে ফটোকপি করা যেতে পারে। প্রশ্নপত্র ফটোকপির প্রয়োজন হলে বিদ্যালয়ের আনুষঙ্গিক খাত থেকে ব্যয় করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই প্রশ্নপত্র ছাপিয়ে শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন গ্রহণ করা যাবে না।
কিন্তু কেন এই কাগজ সংকট বা কাগজের অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি? যেখানে দেশে প্রায় শ-খানেক কাগজ কল রয়েছে। এবং কাগজ উৎপাদনে দেশ অনেক আগেই স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশ থেকে ৪০টিরও বেশি দেশে কাগজ রপ্তানিও হচ্ছে। তার ওপরে আমদানিও থেমে নেই। বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে দেশে অবাধে ঢুকছে আমদানি করা কাগজ। ৭০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে গড়ে ওঠা শিল্প খাতটিতে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে না পেরে একসময়ে লোকসানও গুনেছেন উদ্যোক্তারা। সেখানে এখন কাগজের অতিরিক্ত সংকট।
দেশের কাগজকলগুলো অফসেট, নিউজপ্রিন্ট, লেখা ও ছাপার কাগজ, প্যাকেজিং পেপার, ডুপ্লেক্স বোর্ড, মিডিয়া পেপার, লাইনার, স্টিকার পেপার, সিকিউরিটি পেপার ও বিভিন্ন গ্রেডের টিস্যু পেপার উৎপাদন করে। তবে উৎপাদিত পণ্যের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই লেখা এবং ছাপার কাগজ, যা শিক্ষার অন্যতম উপকরণ। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ চাহিদার চেয়ে প্রায় দেড় থেকে দুই গুণ বেশি পণ্য উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে কাগজকলগুলোর। দেশে বিভিন্ন ধরনের কাগজের চাহিদা প্রায় ৯ লাখ টন। তবে দেশীয় কাগজকলগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ১৬ লাখ টন। দেশের পেপার মার্কেটের আকার প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে বাজারের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ লেখা ও ছাপার কাগজ।
দেশীয় কাগজকলগুলোর সব ধরনের উৎপাদন সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কেন কাগজের সরবরাহ কমে গেছে? এর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে জ্বালানি সংকট। যে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে, তা দিয়ে রেশনিং করে নিত্যপণ্যের মিলগুলো চালুতে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এতে করে অন্য মিলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বাজারে কাগজ সরবরাহেও টান পড়েছে। অন্যদিকে কাগজ উৎপাদনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় কাঁচামাল আমদানি করতে এলসি খুলতে সমস্যার কথাও জানিয়েছেন মিলমালিকরা।
পাইকারি বাজারে কাগজের দাম প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে। হোয়াইট প্রিন্ট কাগজের দাম সপ্তাহের ব্যবধানে টনপ্রতি ২৫ হাজার টাকা বেড়ে দাম দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৫ হাজার থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকায়। প্রতি টন হোয়াইট নিউজপ্রিন্ট কাগজের দাম বেড়েছে ১৫ হাজার টাকা। এ কাগজের দাম ২০ হাজার থেকে বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে প্রতি টন ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকায়। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে লেজার কাগজের দাম। প্রতি টনের দাম ৩০ হাজার টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা।
দ্রব্যমূল্যের উচ্চহার নিয়ে হাহাকার চারদিকে, সবকিছুর দাম বেড়ে গেলেও বাড়ছে না ব্যক্তির আয়। দৈনন্দিন জীবনে মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণে হিমশিম খাচ্ছে জনগণ। ডলার সংকট জ্বালানি সংকটে সর্বত্রই অস্থিরতা বিরাজ করছে। এমতাবস্থায় কাগজের দাম এতটা বেড়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। কাগজের দাম বাড়ায় বাচ্চাদের খাতা কেনার খরচও বেড়েছে। একইভাবে বেড়েছে স্কুল-পরীক্ষার ফি। এতে বাচ্চাদের লেখাপড়া চালানো অনেকের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। নতুন বছরে নতুন বই-খাতা কিনতে তাদের সম্মুখীন হতে হবে বাড়তি ব্যয়ের। যেখানে দেশের ইংরেজি মাধ্যম ও বেসরকারি স্কুল-কলেজগুলোতে বছরের শুরুতেই বই-খাতা কেনার এক লম্বা লিস্ট ধরিয়ে দেওয়া হয়, সেখানে এই বাড়তি ব্যয় মেটাতে অভিভাবকদের যথেষ্ট ভোগান্তি পোহাতে হবে। একই সঙ্গে মুদ্রণশিল্প, ছাপাখানা, পত্রিকা ও প্যাকেজিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও সাধারণ কর্মীদের কর্মসংস্থান হয়ে পড়ছে ঝুঁকির সম্মুখীন। যেকোনো পণ্যের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে হাজারো মানুষের জীবিকা। তাই সরকারের উচিত বছরের শুরুতে এই বিশেষ সময়টায় কাগজের দাম কীভাবে নাগালের মধ্যে রাখা যায় সেদিকে নজর দেওয়া।
লেখক : কথাসাহিত্যিক
ভয়েস/আআ/সূত্র: দেশরূপান্তর