শুক্রবার, ০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৩, ০৩:২৮ পূর্বাহ্ন
সুমনা সরকার:
একজন ব্যক্তি বহু সামাজিক সম্পর্কের ভেতর দিয়েই সামাজিক মানুষ হয়ে ওঠে। এই সামাজিক সম্পর্কগুলো হলো শ্রেণি, পেশা, লিঙ্গ, বাসস্থান, ধর্ম, ভৌগোলিক জন্মসূত্র, খাদ্যাভ্যাস, সাংস্কৃতিক কর্মকা-, রাজনীতি, ভাষা, সংগীত-শিল্পকলার পছন্দ, প্রিয় খেলা প্রভৃতি। ব্যক্তির মতোই প্রতিষ্ঠানেরও রয়েছে সামাজিক রূপ। রাষ্ট্রের অনেকগুলো সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভেতরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অন্যতম। প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি একই সময় সবগুলো সামাজিক সম্পর্কের সঙ্গে সংযুক্ত। সবগুলো সম্পর্ক ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান কোনো গোলমাল ছাড়াই টেনে নিয়ে যেতে পারে অনায়াসে। কিন্তু ঝামেলা বাধে তখনই যখন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানে একটিমাত্র সামাজিক সম্পর্ক বা পরিচয় প্রাধান্য পায়।
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে। এখন সমাজে সবচেয়ে যে সামাজিক পরিচয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে বা চর্চিত হচ্ছে তা হলো ধর্মীয় পরিচয়। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ধর্মীয় পরিচয় প্রাধান্য পাচ্ছে। সম্প্রতি ঢাকা বোর্ডের এইচএসসির বাংলা প্রথম পত্রের একটি ‘সৃজনশীল প্রশ্ন’ নিয়ে গণমাধ্যমসহ সামাজিক মাধ্যমে ঝড় চলছে। সবাই সাম্প্রদায়িক উসকানিদাতা হিসেবে প্রশ্ন প্রস্তুতকারী শিক্ষক এবং মডারেটরদের নিন্দা করছে বা শাস্তি চাচ্ছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে সাম্প্রদায়িক উসকানিদাতা হিসেবে শুধু তাদের নিন্দা করাটা কতটুকু যৌক্তিক? এই শিক্ষকরা তো সমাজ থেকে উঠে আসা সমাজে বসবাসকারী মানুষই বটে। তারা কি সমাজ বিচ্ছিন্ন কোনো স্বতন্ত্র প্রজাতি? এই কালে সমাজ, রাষ্ট্রের কোনো ক্ষেত্রটিতে সাম্প্রদায়িকতার চাষবাস হচ্ছে না?
প্রশ্নকর্তা এবং মডারেটর সবাই দেখলাম মফস্বলের মানুষ। শুধু মফস্বল নয় অন্যসব সমাজের তুলনায় এই উপমহাদেশের শিক্ষকের মর্যাদা, শ্রদ্ধা, গ্রহণযোগ্যতা এখনো বেশি। যদিও শিক্ষকের মর্যাদা আগের চেয়ে ক্ষয়িষ্ণু কিন্তু একেবারে বিলীন না। মফস্বলের শিক্ষকদের সঙ্গে স্কুল-কলেজের ছাত্রদের বা স্কুল-কলেজের আশপাশের পরিবারের মানুষদের সঙ্গে সম্পর্ক একটা পর্যায়ে থাকে। বিপদে-আনন্দে-সংকটে পরামর্শ বা অনুভূতি ভাগাভাগি করতে এখনো মফস্বলের শিক্ষকের কাছে ছাত্রের পরিবার, এলাকার মানুষ যায়। সমাজকে খুব কাছ থেকে দেখে বলেই সমাজের ভাবনা, অনুভূতি দ্বারা তারা তাড়িত হন। প্রশ্নের ওই ‘উদ্দীপক’টি আসলে বাস্তবতার ছবিই।
তবে আমার মনে হয়, সাম্প্রদায়িক উসকানিদাতা হিসেবে তারা যে গালমন্দের শিকার হচ্ছেন তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুতর অপরাধ তারা করেছেন ওই প্রশ্নপত্রে। সেই অপরাধটি একেবারে উপেক্ষিত। উপেক্ষিত বিষয়টি নিয়ে পরে আলোচনা করছি। তার আগে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে যা বলার তা হলো, আমাদের এই অঞ্চলের ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যেমন পুরনো ঐতিহ্য রয়েছে, তেমনি রয়েছে সাম্প্রদায়িক হানাহানির ইতিহাসও। সম্প্রদায়ভিত্তিক সমাজে কোনো না কোনো রূপে সাম্প্রদায়িকতা থাকবেই। তবে রাষ্ট্রের শাসকদের সদিচ্ছায় সাম্প্রদায়িকতাকে নমনীয় বা সহনীয় করে রাখা যায় বা রাখেও। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প আজ যেভাবে ছেয়ে গেছে তা আসলে ধামাচাপা দেওয়া সম্ভব (যদি শাসকশ্রেণি চায়) কিন্তু সমূলে উৎপাটন করতে চাইলে সমাজ পরিবর্তনের বিকল্প নেই।
এবার আসি আমার বিবেচনায় সবচেয়ে নিন্দনীয় বিষয়টি নিয়ে। ‘সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে’ ‘উদ্দীপক’টি হচ্ছে নেপাল ও গোপাল নামে দুই ভাইকে নিয়ে। এই দুই ভাই শুধু পরস্পরের প্রতিপক্ষই না চরম প্রতিহিংসাপরায়ণও। একজন আরেকজনের অস্তিত্বই বিলীন করতে চায়। ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের বিদে¦ষকে উসকে দেওয়াকে আমরা আমলে নিচ্ছি না। কারণ, আমাদের মগজও শুধু ‘ধর্মীয় সহাবস্থান’ চায়। আর সবকিছুর সম্প্রীতির বোধ এসব সমালোচনাকারীর কাছে নগণ্য। ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের হিংসা-দ্বেষের প্রশ্ন আমাদের সংস্কৃতির প্রতি আঘাত। ভারতবর্ষের চিরায়ত ইতিহাস হচ্ছে ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা-আস্থা-বিশ্বাসের। মহাকাব্যের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত যা বহমান।
আমাদের সংস্কৃতি প্রবলভাবে পরিবারনির্ভর। এই অঞ্চলের পরিবারপ্রথা এত বেশি শক্তিশালী যে, পরিবার পাশে না থাকলে এখানে একজন ব্যক্তির টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। উন্নত সমাজে ব্যক্তির জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত রাষ্ট্র পাশে থাকে। চিকিৎসা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, বৃদ্ধ হলে দেখাশোনার কোথায় নেই রাষ্ট্রের ছোঁয়া! কিন্তু আমাদের সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তির আমৃত্যু পর্যন্ত দায় পরিবারের। বিশেষ করে ভালোবাসা-ভরসা-নিরাপত্তায় বাবা-মার পরেই ভাইবোনের স্থান। সে কারণে গান, গল্প, উপন্যাস, নাটক, সিনেমার প্লট ভীষণভাবে পরিবারকেন্দ্রিক। আর ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের আত্মত্যাগের নিদর্শন তো মহাকাব্যের যুগ থেকেই পেয়ে আসছি। ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের সাহস, শক্তি, ভক্তি, কর্তব্যে যে নজির রামায়ণ, মহাভারতে আছে তা আজও সমানভাবে বর্তমান। ছেলেবেলায় গ্রামে কত সেলাই করে বাঁধাই অবস্থায় দেখেছি ‘পিতা গেলে পিতা পাবো পুত্র বুকে নিয়ে, মাতা গেলে মাতা পাই কন্যা বুকে লয়ে, ভাই গেলে ভাই কোথা সে পাই?’ এমন অসংখ্য প্রবাদের উল্লেখ করা যায়। নাটক-সিনেমা-উপন্যাস-গল্প-গানের উদাহরণে নাইবা গেলাম আর।
অনেকেই হয়তো এই প্রশ্ন তুলতে পারেন যে, সাম্প্রদায়িকতার চিত্র যদি বাস্তবতার প্রতিবিম্ব হয় তবে, ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের দ্বেষও বাস্তবতা। বাস্তবতা, তবে তা খুবই ক্ষুদ্র অংশের। সমাজের মূল সুরই তো ‘জনম জনম রাখবো ধরে ভাই হারানো জ্বালা’র। আর একটি বিষয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা যত না ব্যক্তিক বা স্থানিক তার চেয়ে অনেক বেশি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক। ব্যক্তির দায় এখানে সামান্যই। কিন্তু ভাইবোন বা পরিবারকে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, আস্থা সিংহভাগই নির্ভর করে ব্যক্তির শুভবোধের ওপর।
একজন শিক্ষকের অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে শুভবোধকে জাগ্রত করা। কিন্তু সৃজনশীল প্রশ্নকারী শিক্ষকরা ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের বিদ্বেষ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে চাচ্ছেন। আমার নিন্দা বা সমালোচনা শিক্ষকদের প্রতি এ কারণেই।
লেখক : পিএইচডি গবেষক, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়