শুক্রবার, ০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৩, ০২:৫৫ পূর্বাহ্ন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
দুনিয়ায় মানুষের সব কাজই গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে কোরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে।’ সুরা যিলযাল : ৭-৮
আয়াতে আরবি ‘যাররাহ’ শব্দকে বস্তুর সবচেয়ে ছোট অংশ বোঝাতে বাংলায় ‘অণু পরিমাণ’ বলা হয়েছে। কোনো কোনো আলেমের কাছে পিঁপড়া থেকেও ছোট বস্তুকে যাররাহ বোঝায়। কেউ বলেন, মাটিতে হাত মেরে ঝেড়ে ফেলার পর হাতে যে মাটি অবশিষ্ট থাকে, সেটাই যাররাহ। আবার কেউ বলেন, ঘরের দরজা কিংবা জানালার ছিদ্র দিয়ে সূর্যের ছটার সঙ্গে যে ধূলিকণা দেখা যায়, সেটাই হলোযাররাহ।
ইসলামের দৃষ্টিতে এই অণু পরিমাণ সৎকাজেরও মূল্য রয়েছে, অনুরূপ অবস্থা অসৎকাজের। অসৎকাজ যত ছোটই হোক না কেন, অবশ্যই তার হিসাব হবে এবং তা কোনোক্রমেই উপেক্ষার মতো নয়। তাই কোনো ছোট সৎকাজকে ছোট মনে করে তা পরিত্যাগ করা উচিত নয়। কারণ এ ধরনের অনেক সৎকাজ মিলে দয়াময় আল্লাহর কাছে একটি অনেক বড় সৎকাজ গণ্য হতে পারে। অনুরূপভাবে কোনো ছোট ও নগণ্য অসৎকাজও না করা। কারণ এ ধরনের অনেকগুলো ছোট গোনাহ একত্র হয়ে বিরাট গোনাহের স্তূপ হয়ে যেতে পারে। হাদিসে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচো, তা এক টুকরো খেজুর দান কিংবা একটি ভালো কথা বলার বিনিময়েই হোক না কেন।’ সহিহ বোখারি : ৬৫৪০
হাদিসে আরও ইরশাদ হয়েছে, সাহাবি হজরত আবু যর গিফারি (রা.) বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেন, ‘কোনো ভালো কাজকে সামান্য মনে করো না। যদিও তা হয় তোমার ভাইয়ের সঙ্গে হাসিমুখে সাক্ষাৎ।’ সহিহ মুসলিম : ২৬২৬
হাদিসে একজন মুসলিমের সঙ্গে হাসিমুখে সাক্ষাৎকে ভালো কাজ উল্লেখ করে এই ভালো কাজের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। স্বয়ং আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার প্রিয় সাহাবিকে এ বিষয়ে উৎসাহিত করেছেন। বর্ণিত হাদিসের আলোকে ইসলামি স্কলাররা বলেছেন, ‘একজন মুসলিমের সঙ্গে হাসিমুখে সাক্ষাৎ মুস্তাহাব ও পছন্দনীয় আমল। রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত।’
আল্লাহর রাসুল (সা.) একটি মূলনীতি উল্লেখ করে এ বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। মূলনীতিটি হচ্ছে, ‘তুমি কোনো ভালো কাজকেই সামান্য মনে করো না।’ এটা দুনিয়ায় করণীয় সম্পর্কে একটি বড় মূলনীতি। কোনো ভালো কাজকে সামান্য মনে করে ত্যাগ না করা। বিষয়টি ভালোভাবে অনুধাবন করলে অনেক ধরনের বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।
প্রশ্ন হলো, ভালো ও মন্দকাজ কাকে বলে? ইবাদত-বন্দেগি অবশ্যই ভালো কাজ। এই মূলনীতি ইবাদত-বন্দেগির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। একটু সময় পেলেন, তা দুই রাকাত নফল নামাজ, আধা পৃষ্ঠা কোরআন মজিদ তেলাওয়াত কিংবা তাসবিহ পাঠ করতে পারেন। আবার ওই সময়টুকুই আপনি অযথা গল্পগুজব, গিবত-শেকায়েতে নষ্ট করতে পারেন।
এভাবে আচার-ব্যবহার, লেনদেন, কথাবার্তা, সামাজিকতা ও চলাফেরার ক্ষেত্রেও ইচ্ছা করলে ছোট ছোট ভালো কাজ করা যায়। মানুষের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলা, সত্যিকারের অভাবীকে ঋণ পরিশোধের সময় বাড়িয়েও দেওয়া থেকে শুরু করে সবার সঙ্গে নম্র-কোমল ব্যবহার করা। সাধ্যমতো মানুষের উপকার করা। আগন্তুককে পথ চেনানো ইত্যাদি। এর বিপরীত কাজগুলোই গোনাহের কাজ।
কোনো কাজ সামান্য মনে করার বিভিন্ন কারণ হতে পারেকাজটি ছোট বলে সামান্য মনে করা, নিজের অবস্থার নিরিখে কাজটিকে সামান্য মনে করা ইত্যাদি। অনেক মানুষের এমন ধারণা, আমি তো অনেক গোনাহ করেছি, অনেক পাপ করেছি, আমার সামান্য নেক আমলে আর কী হবে? না, শরিয়ত বলে, তুমি সামান্য নেক আমলকেও সামান্য মনে করো না। হতে পারে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই ভালো কাজের বিনিময়ে তোমাকে আরও ভালো কাজ করার তওফিক দান করবেন, হতে পারে এই ভালো কাজের কারণে আল্লাহতায়ালা তোমাকে মাফ করে দেবেন। অন্য হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) মেয়েদের সম্বোধন করে বলেছেন, ‘হে মুসলিম মেয়েরা! কোনো প্রতিবেশী তার প্রতিবেশিনীর বাড়িতে কোনো জিনিস পাঠানোকে সামান্য ও নগণ্য মনে করো না, তা ছাগলের পায়ের একটি খুর হলেও।’ সহিহ বোখারি : ৬০১৭
রাসুলুল্লাহ (সা.) অন্যত্র বলেন, ‘হে আয়েশা! যেসব গোনাহকে ছোট মনে করা হয়, সেগুলো থেকে দূরে থাকো। কারণ আল্লাহর দরবারে সেগুলো সম্পর্কেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ ইবনে মাজাহ : ৪২৪৩
নবী করিম (সা.) আরও বলেন, ‘সাবধান, ছোট গোনাহসমূহ থেকে নিজেকে রক্ষা করো। কারণ সেগুলো সব মানুষের ওপর একত্র হয়ে তাকে ধ্বংস করে দেবে।’ মুসনাদে আহমাদ : ১/৪০২
সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে আরেকটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের জুতার ফিতার চেয়েও জান্নাত তোমাদের হাতের নাগালে আর জাহান্নামও তেমনি।’ সহিহ বোখারি : ৬১২৩
আল্লামা ইবনুল জাওযি (রহ.) বলেন, হাদিসের অর্থ, জান্নাতে যাওয়া খুব সোজা। শুধু নিয়ত শুদ্ধ করো আর আল্লাহর হুকুম মানো। তেমনি জাহান্নামের যাওয়াও কঠিন নয়। মনমতো চলো আর গোনাহ করো। ইবনে বাত্তাল (রহ.) বলেন, বর্ণিত হাদিসে এই বার্তা রয়েছে যে, আল্লাহর আনুগত্য মানুষকে জান্নাতে পৌঁছায় আর আল্লাহর অবাধ্যতা জাহান্নামে নিক্ষেপ করে। আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে আনুগত্য ও অবাধ্যতা দুটোই হয় খুব সহজ কাজে।
সহিহ বোখারির ভাষ্যকার ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন, ‘সুতরাং প্রত্যেকের কর্তব্য, সামান্য ভালো কাজও সামান্য ভেবে ছেড়ে না দেওয়া। আর সামান্য গোনাহতেও সামান্য ভেবে লিপ্ত না হওয়া। কারও তো জানা নেই, কোন ভালো কাজটি তার জন্য আল্লাহর করুণা ও বরকত বয়ে আনবে। তেমনি কোন মন্দকাজ তাকে আল্লাহর অসন্তুষ্টির শিকার করবে।’
ইসলামের এতসব শিক্ষা ও নির্দেশনার সারকথা, ভালো মানুষ হওয়া। আমাদের সব শিক্ষা-দীক্ষা, সেটা জাগতিক শিক্ষা হোক বা ধর্মীয় শিক্ষা, প্রকৃত অর্থে যা শিক্ষা তার সারকথা হচ্ছে, ‘তুমি একজন ভালো মানুষ হও।’
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক