রবিবার, ২৯ মে ২০২২, ০৪:৩৫ পূর্বাহ্ন
মুহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত:
যেখানে ভয় ও আনুগত্য আছে, সেখানে ভালোবাসা থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে। কিন্তু যেখানে ভালোবাসা আছে সেখানে অবশ্যই ভয় ও আনুগত্য থাকবে।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে ইমানদাররা! আল্লাহকে যেমন ভয় করা উচিত ঠিক তেমনিভাবে ভয় করতে থাকো। (এবং) অবশ্যই মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ কোরো না।’ -সুরা আলে ইমরান : ১০২
বর্ণিত আয়াতে আল্লাহতায়ালাকে পূর্ণরূপে ভয় করার অর্থ, তার আনুগত্য করবে, অবাধ্য হওয়া যাবে না, তাকে সদাসর্বদা স্মরণ করবে, কোনো সময়েই তাকে ভুলে যাওয়া চলবে না। তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে, কৃতঘ্ন হওয়া যাবে না। অতঃপর আয়াতের পরের অংশে বলা হয়েছে, ‘তোমরা মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ কোরো না।
অর্থাৎ আজীবন ইসলামের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকো, যাতে মৃত্যুও এর ওপরই হয়। এ মহান প্রভুর নিয়ম এই যে, মানুষ স্বীয় জীবন যেভাবে পরিচালনা করে সেভাবেই মহান প্রভু তার মৃত্যু দিয়ে থাকেন। যার ওপর মৃত্যু সংঘটিত হবে তার ওপরই কেয়ামতের দিন তাকে উত্থিত করবেন।
মানুষ নানা কারণে একে অপরকে ভয় করে। চোর পুলিশকে ভয় করে মার খাওয়ার ভয়ে, চাকর মালিককে ভয় করে অতিরিক্ত কাজ ও পারিশ্রমিক যথাযথ না পাওয়ার ভয়ে, পথিক ঠগবাজদের ভয় করে হাতের থলে লুট হওয়ার ভয়ে।
এখানে মুমিন ব্যক্তিরাও কি তেমন কোনো কারণে ভয় করবে? একদমই না! বরং মুমিনরা আল্লাহতায়ালাকে ভয় করবে আল্লাহ ও বান্দার মধ্যকার ভালোবাসার বন্ধন ছিন্ন হওয়ার ভয়ে। মাবুদ ও তার বান্দার মধ্যে বিশেষ চুক্তি রয়েছে, যে চুক্তি সম্পাদনের মধ্যদিয়ে মাবুদ ও বান্দার ভালোবাসার পরিপূর্ণতা পায়।
আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহতায়ালা মুমিনদের কাছ থেকে তাদের প্রাণ ও তাদের ধন সম্পদসমূহকে এর বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছেন যে, তাদের জন্য জান্নাত রয়েছে, তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে, যাতে তারা (কখনো) হত্যা করে এবং (কখনো) নিহত হয়, এর কারণে (জান্নাত প্রদানের) সত্য অঙ্গীকার করা হয়েছে তাওরাতে, ইঞ্জিল এবং কোরআনে কারিমে। নিজের অঙ্গীকার পালনকারী আল্লাহ অপেক্ষা অধিক আর কে আছে? অতএব তোমরা আনন্দ করতে থাকো তোমাদের এই ক্রয় বিক্রয়ের ওপর, যা তোমরা সম্পাদন করেছ, আর এটা হচ্ছে বিরাট সফলতা।’
-সুরা তাওবা : ১১১
মুমিনদের জান্নাত লাভের জন্য মাবুদের সঙ্গে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করতে হবে। কোনো ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিশ্বাস স্থাপনপূর্বক ইমান এনে মুমিন হতে হয়। অতঃপর মুমিনরা আল্লাহর সঙ্গে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করার লক্ষ্যে নিজের অনেক অভিলাষ বিসর্জন দিয়ে মাবুদের দরবারে আত্মসমর্পণ করে, শরিয়তের বিধান পালনে নানাবিধ কষ্ট স্বীকার করে।
এমতাবস্থায় কোনো ব্যক্তি যদি আল্লাহকে ভয় করেই ইবাদত-বন্দেগি করে তাহলে তার ইবাদত হবে গতানুগতিক ধারার আদেশ পালনের ইবাদত। কিন্তু কেউ যদি মাবুদের ভালোবাসার স্বীকৃতিস্বরূপ ইবাদত করে, তবে তার ইবাদতে থাকবে একাগ্রতা, আন্তরিকতা, নিষ্ঠা। কোনো ব্যক্তি একাগ্রতার সঙ্গে ইবাদত না করলে কখনো তার ইবাদত কবুল হবে না।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আমি তোমার প্রতি এ কিতাব (কোরআন মাজিদ) অবতীর্ণ করেছি সত্যতা সহকারে, (এতে নেই কোনো প্রকার মিথ্যে) কাজেই আল্লাহর ইবাদত করো দ্বীনকে (আনুগত্য, হুকুম পালন, দাসত্ব ও গোলামিকে) একমাত্র তারই (আল্লাহর) জন্য নির্দিষ্ট করে।’ -সুরা যুমার : ২
মহান আল্লাহ কোরআনে কারিমের সুরা ফাতেহার প্রথম আয়াতে বলেন, ‘সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য, তিনি সারা জাহানের রব।’ অতঃপর দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তিনি মেহেরবান দয়াময়।’
এখানে প্রথম আয়াতে মহান রবের বড়ত্ব প্রকাশে মানুষ যেহেতু ভয় না পায়, সে জন্য সঙ্গে সঙ্গেই দ্বিতীয় আয়াতে মহান রবের দয়ার কথা বলেছেন। যাতে মানুষ আল্লাহকে ভয় করার পাশাপাশি তার দয়ার কথা স্মরণপূর্বক তাকে ভালোবাসতে পারে।
সৃষ্টিকর্তা দয়াময় আল্লাহকে ভালোবাসার জন্য হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অনুসরণ-অনুকরণ করতে হবে। ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমার নবী (সা.)-এর অনুসরণ করো; তাহলে মহান আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ মার্জনা করবেন।’
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ মুমিন হবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার সন্তান অপেক্ষা, তার পিতা অপেক্ষা এবং সব মানুষ অপেক্ষা বেশি প্রিয় (ভালোবাসার বস্তু) না হই।’ -সহিহ বোখারি
অন্য হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘যে যাকে ভালোবাসে সে (পরকালে) তার সঙ্গে থাকবে।’ -সহিহ মুসলিম
হাদিসে আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘যে আমার সুন্নতকে ভালোবাসে সে অবশ্যই আমাকে ভালোবাসে, আর যে আমাকে ভালোবাসে সে জান্নাতে আমার সঙ্গেই থাকবে।’ -নাসায়ি শরিফ
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রায়ই এই দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! আপনার ভালোবাসা চাই, আপনার ভালোবাসার জন্য ভালোবাসা চাই; আর সে আমল করার তাওফিক চাই, যে আমল করলে আপনার ভালোবাসা লাভ করা যায়।’ -মুয়াত্তা ইমাম মালিক
সুতরাং মহান আল্লাহকে ভয় করার চেয়েও ভালোবাসা জরুরি। কোনো ব্যক্তি আল্লাহকে ভালোবাসলে আল্লাহ তার গোনাহসমূহ মাফ করে দেবেন। যার গোনাহ মাফ হয়ে যাবে, তার জন্য জান্নাত অবধারিত। মহান প্রভু আমাদের তার ভালোবাসার অসীম সাগরে ডুবে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : ধর্মীয় নিবন্ধকার
ভয়েস/আআ/সুত্র: দেশরূপান্তর